যারা আমার সাঁঝ-সকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিলে আলো আপন হিয়ার পরশ দিয়ে; এই জীবনের সকল সাদা কালো যাদের আলো-ছায়ার লীলা; সেই যে আমার আপন মানুষগুলি নিজের প্রাণের স্রোতের 'পরে আমার প্রাণের ঝর্না নিল তুলি; তাদের সাথে একটি ধারায় মিলিয়ে চলে, সেই তো আমার আয়ু, নাই সে কেবল দিন-গণনার পাঁজির পাতায়, নয় সে নিশাস-বায়ু। তাদের বাঁচায় আমার বাঁচা আপন সীমা ছাড়ায় বহু দূরে; নিমেষগুলির ফল পেকে যায় নানা দিনের সুধার রসে পুরে; অতীত কালের আনন্দরূপ বর্তমানের বৃন্ত-দোলায় দোলে-- গর্ভ হতে মুক্ত শিশু তবুও যেন মায়ের বক্ষে কোলে বন্দী থাকে নিবিড় প্রেমের বাঁধন দিয়ে। তাই তো যখন শেষে একে একে আপন জনে সূর্য-আলোর অন্তরালের দেশে আঁখির নাগাল এড়িয়ে পালায়, তখন রিক্ত শীর্ণ জীবন মম শুষ্ক রেখায় মিলিয়ে আসে বর্ষাশেষের নির্ঝরিণী-সম শূন্য বালুর একটি প্রান্তে ক্লান্ত বারি স্রস্ত অবহেলায়। তাই যারা আজ রইল পাশে এই জীবনের অপরাহ্নবেলায় তাদের হাতে হাত দিয়ে তুই গান গেয়ে নে থাকতে দিনের আলো-- বলে নে, "ভাই, এই যা দেখা, এই যা ছোঁওয়া এই ভালো এই ভালো। এই ভালো আজ এ সংগমে কান্নাহাসির গঙ্গা-যমুনায় ঢেউ খেয়েছি, ডুব দিয়েছি, ঘট ভরেছি, নিয়েছি বিদায়। এই ভালো রে প্রাণের রঙ্গে এই আসঙ্গ সকল অঙ্গে মনে পুণ্য ধরার ধুলো মাটি ফল হাওয়া জল তৃণ তরুর সনে। এই ভালো রে ফুলের সঙ্গে আলোয় জাগা, গান গাওয়া এই ভাষায়-- তারার সাথে নিশীথ রাতে ঘুমিয়ে পড়া নূতন-প্রাতের আশায়।'
তখন আকাশতলে ঢেউ তুলেছে পাখিরা গান গেয়ে। তখন পথের দুটি ধারে ফুল ফুটেছে ভারে ভারে, মেঘের কোণে রঙ ধরেছে দেখি নি কেউ চেয়ে। মোরা আপন মনে ব্যস্ত হয়ে চলেছিলেম ধেয়ে। মোরা সুখের বশে গাই নি তো গান, করি নি কেউ খেলা। চাই নি ভুলে ডাহিন-বাঁয়ে, হাটের লাগি যাই নি গাঁয়ে, হাসি নি কেউ, কই নি কথা, করি নি কেউ হেলা। মোরা ততই বেগে চলেছিলেম যতই বাড়ে বেলা। শেষে সূর্য যখন মাঝ-আকাশে, কপোত ডাকে বনে-- তপ্ত হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে শুকনো পাতা বেড়ায় উড়ে, বটের তলে রাখালশিশু ঘুমায় অচেতনে, আমি জলের ধারে শুলেম এসে শ্যামল তৃণাসনে। আমার দলের সবাই আমার পানে চেয়ে গেল হেসে। চলে গেল উচ্চশিরে, চাইল না কেউ পিছু ফিরে, মিলিয়ে গেল সুদূর ছায়ায় পথতরুর শেষে। তারা পেরিয়ে গেল কত যে মাঠ, কত দূরের দেশে! ওগো ধন্য তোমরা দুখের যাত্রী, ধন্য তোমরা সবে। লাজের ঘায়ে উঠিতে চাই, মনের মাঝে সাড়া না পাই, মগ্ন হলেম আনন্দময় অগাধ অগৌরবে-- পাখির গানে, বাঁশির তানে, কম্পিত পল্লবে।
আমি মুগ্ধতনু দিলেম মেলে বসুন্ধরার কোলে। বাঁশের ছায়া কী কৌতুকে নাচে আমার চক্ষে মুখে, আমের মুকূল গন্ধে আমায় বিধুর ক'রে তোলে-- নয়ন মুদে আসে মৌমাছিদের গুঞ্জনকল্লোলে। সেই রৌদ্রে-ঘেরা সবুজ আরাম মিলিয়ে এল প্রাণে। ভুলে গেলেম কিসের তরে বাহির হলেম পথের 'পরে, ঢেলে দিলেম চেতনা মোর ছায়ায় গন্ধে গানে-- ধীরে ঘুমিয়ে প'লেম অবশ দেহে কখন কে তা জানে। শেষে গভীর ঘুমের মধ্য হতে ফুটল যখন আঁখি, চেয়ে দেখি, কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ শিয়রদেশে তোমার হাসি দিয়ে আমার অচৈতন্য ঢাকি-- ওগো, ভেবেছিলেম আছে আমার কত-না পথ বাকি।
মোরা ভেবেছিলেম পরানপণে সজাগ রব সবে-- সন্ধ্যা হবার আগে যদি পার হতে না পারি নদী, ভেবেছিলেম তাহা হলেই সকল ব্যর্থ হবে। যখন আমি থেমে গেলেম, তুমি আপনি এলে কবে।
কে তুমি দিয়েছ স্নেহ মানবহৃদয়ে, কে তুমি দিয়েছ প্রিয়জন! বিরহের অন্ধকারে কে তুমি কাঁদাও তারে, তুমি কেন গো সাথে কর না ক্রন্দন! প্রাণ যাহা চায় তাহা দাও বা না দাও, তা বলে কি করুণা পাব না? দুর্লভ ধনের তরে শিশু কাঁদে সকাতরে, তা বলে কি জননীর বাজে না বেদনা? দুর্বল মানব-হিয়া বিদীর্ণ যেথায়, মর্মভেদী যন্ত্রণা বিষম, জীবন নির্ভরহারা ধুলায় লুটায়ে সারা, সেথাও কেন গো তব কঠিন নিয়ম। সেথাও জগৎ তব চিরমৌনী কেন, নাহি দেয় আশ্বাসের সুখ। ছিন্ন করি অন্তরাল অসীম রহস্যজাল কেন না প্রকাশ পায় গুপ্ত স্নেহমুখ! ধরণী জননী কেন বলিয়া উঠে না --করুণমর্মর কণ্ঠস্বর-- "আমি শুধু ধূলি নই, বৎস, আমি প্রাণময়ী জননী, তোদের লাগি অন্তর কাতর। "নহ তুমি পরিত্যক্ত অনাথ সন্তান চরাচর নিখিলের মাঝে; তোমার ব্যাকুল স্বর উঠিছে আকাশ-'পর, তারায় তারায় তার ব্যথা গিয়ে বাজে।" কাল ছিল প্রাণ জুড়ে, আজ কাছে নাই-- নিতান্ত সামান্য এ কি নাথ? তোমার বিচিত্র ভবে কত আছে কত হবে, কোথাও কি আছে প্রভু, হেন বজ্রপাত? আছে সেই সূর্যালোক, নাই সেই হাসি-- আছে চাঁদ, নাই চাঁদমুখ। শূন্য পড়ে আছে গেহ, নাই কেহ, নাই কেহ-- রয়েছে জীবন, নেই জীবনের সুখ। সেইটুকু মুখখানি, সেই দুটি হাত, সেই হাসি অধরের ধারে, সে নহিলে এ জগৎ শুষ্ক মরুভূমিবৎ-- নিতান্ত সামান্য এ কি এ বিশ্বব্যাপারে? এ আর্তস্বরের কাছে রহিবে অটুট চৌদিকের চিরনীরবতা? সমস্ত মানবপ্রাণ বেদনায় কম্পমান নিয়মের লৌহবক্ষে বাজিবে না ব্যথা!